Cart

No products in the cart.

Blog

  • Home
  • Islamic

সাইয়িদা খাইরুন্নেসা রহ.

সাইয়িদা খাইরুন্নেসা রহ.

বিগত শতকের বিশ্ববরেণ্য একজন আলেম হচ্ছেন আলী হাসান আলী নদবি রহ.। আরব ও আজমে যার গ্রহণযোগ্যতা ছিল তুঙ্গে। তাঁর চিন্তা ও সাহিত্যকর্মে প্রভাবিত ছিল পুরো দুনিয়া। চিন্তাচেতনায় তাঁকে আদর্শ মানে অগণিত ইসলামি চিন্তাবিদ। তাঁর যে সাহিত্যকর্মগুলো আজও তাঁকে অমর করে রেখেছে তন্মধ্যে একটি হচ্ছে, ‘মা যা খাসিরাল আলামু বিনহিত্বাতিল মুসলিমিন’ (মুসলমানদের অধঃপতনে বিশ্ব কী হারাল?)। বাংলা ছাড়াও একাধিক ভাষায় অনূদিত হয়েছে বইটি। এই কিংবদন্তির গর্ভধারিণী যিনি, সেই রতœগর্ভা মাকে নিয়ে আমাদের এবারের আলোচনা।
তাঁর নাম ছিল সাইয়িদা খাইরুন্নেসা। জন্ম হয়েছিল ১২৯৫ হিজরিতে। সম্রান্ত ও ধর্মীয় পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন তিনি।
তাঁর পিতা শাহ জিয়াউন নবি ছিলেন শাহ আলামুল্লাহ রহ.-এর সপ্তম অধস্তন পুরুষ। আর শাহ আলামুল্লাহ হচ্ছেন, মুজাদ্দিদে আলফে সানি রহমাতুল্লাহি আলাইহির প্রখ্যাত খলিফা সাইয়িদ আদম বানুরির বিশিষ্ট খলিফা। ১০৯৬ হিজরিতে ইন্তেকাল হয় তাঁর। রায়বেরেলি শহরের বাইরে সাই নদীর ধারে অবস্থিত বস্তি ‘দায়েরায়ে শাহ আলামুল্লাহ’ এই মহান বুজুর্গের নাম ধারণ করে প্রসিদ্ধ হয়ে আছে। উপমহাদেশের বিখ্যাত মুজাহিদ ও সংস্কারক হজরত সাইয়িদ আহমদ শহীদ ছিলেন তাঁরই পঞ্চম অধস্তন পুরুষ।
হজরত শাহ জিয়াউন নবি ছিলেন অত্যন্ত উঁচু পর্যায়ের বুজুর্গ। আল্লাহ তাআলা তাঁকে ধর্মীয় ও পার্থিব উভয় ধরনের সম্পদেই করেছিলেন সম্পদশালী। সাইয়িদ আহমদ শহীদের তরিকায় খিলাফত পেয়েছিলেন তিনি। তাঁর মুরিদদের মধ্যে ছিলেন বড় বড় আলেম ও বুজুর্গ। তাঁকে দেখলেই যে কেউ বুঝতে পারত, আল্লাহ তাআলা তাঁকে একমাত্র তাঁর জিকির ও পারলৌকিক জগতের জন্যই সৃষ্টি করেছিলেন। একাগ্রচিত্ততা ও তন্ময়তার ক্ষেত্রে তাঁর নামাজ ছিল প্রবাদতুল্য। প্রতিবেশী ও নিকটজনদের মুখে মুখে ছিল তাঁর নামাজের প্রশংসা। নিয়ত বাঁধার সঙ্গে সঙ্গেই তিনি নামাজে এমনভাবে ডুবে যেতেন, দুনিয়ার কোনো কিছুর খবর থাকত না তাঁর। শেষ বয়সে কাঁপুনি রোগ দেখা দিয়েছিল তাঁর মধ্যে। হাঁটতে গেলে মনে হতো, এই বুঝি পড়ে যাবেন তিনি। কিন্তু সে অবস্থাতেও নামাজের কাতারে দাঁড়ালে ইমাম তাকবির বলতেই তিনি এমনভাবে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে যেতেন, মনে হতো নিশ্চল একটা কাঠের মূর্তি দাঁড়িয়ে আছে। কখনো কখনো রাত্রিকালীন নামাজে অংশ নিতেন এবং দাঁড়িয়ে (নামাজরত অবস্থায়) গোটা কুরআন মাজিদ শুনতেন। সুস্থ-সবল, তরুণ-যুবকদেরকেও অনেক সময় দেখা যায়, ক্লান্ত হয়ে বসে গিয়েছে। কিন্তু তিনি দাঁড়িয়ে থাকতেন পাথরের মতো। দূর থেকে দেখলে মনে হবে কেউ যেন এক খণ্ড কাঠ পুঁতে রেখেছে মাটিতে।
তাঁর সান্নিধ্যের প্রভাব ছিল এতটাই গভীর যে, কেউ যদি কয়েক দিন তাঁর সঙ্গে ওঠাবসা করে তাহলেই তাঁর মধ্যে জন্মে যেত নামাজের প্রতি চরম আসক্তি। তাঁর হৃদয়ে জেগে উঠত সুন্নতে রাসুলের প্রতি গভীর ভালোবাসা।
দুনিয়ার প্রতি কোনো ধরনের মোহ বা লোভ লালসা ছিল না তাঁর মাঝে। পৈতৃক সূত্রে অনেক জমিজমা পেয়েছিলেন তিনি। কয়েকটি গ্রামের জমিদারির মালিকানা উত্তরাধিকারসূত্রে লাভ করেছিলেন তিনি ও তাঁর ভাই সাইয়েদ রশিদউদ্দিন। কোনো বোনও ছিল না তাঁদের। প্রচুর ধনসম্পত্তি থাকায় কোনো প্রকার অভাব ছিল না তাঁদের পরিবারে। ফলে নিশ্চিন্তেই ইবাদত-বন্দেগির ভিতর দিয়ে দিনাতিপাত করতে থাকেন তিনি। পার্থিব কোনো কিছুর প্রতি তেমন কোনো আগ্রহ ছিল না তাঁর। বরং সমস্ত আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু ছিল ধর্মীয় বই-পুস্তক। তেমন কোনো বইয়ের সন্ধান পেলে অমনি তা সংগ্রহের জন্য উঠে পড়ে লাগতেন এবং প্রয়োজনীয় অর্ডার দিতেন। অতঃপর অধীর আগ্রহে দিন গনা শুরু করতেন।
বইপ্রাপ্তির এই আগ্রহ তাঁর এত অধিক ছিল যে, একবার তিনি এক বইয়ের অর্ডার দিয়ে অপেক্ষা শুরু করেন। ইত্যবসরেই মারা যায় তাঁর এক মেয়ে কিংবা ঘনিষ্ঠ আত্মীয়। তাঁর দাফন অনুষ্ঠানে শরিক হন তিনি। সেই অনুষ্ঠানে থাকাকালীনই নিজের ছোট ছেলে ওবায়দুল্লাহকে ডেকে বলেন, “ওবায়েদ! বইটা তো এখনও এসে পৌঁছল না!” এটা শুনে আশপাশের লোকেরা বিস্মিত হয়ে গেল যে, এই অবস্থায়ও তিনি পড়ে আছেন বই নিয়ে!
বিষয় সম্পত্তির দেখাশোনা ও খোঁজখবর নেবার দিকে তাঁর বিন্দুমাত্র আগ্রহ ছিল না। এর সঙ্গে কোনো সম্পর্কও ছিল না তাঁর। যতদিন তাঁর বড় ভাই সাইয়িদ রশিদুদ্দিন বেঁচে ছিলেন ততদিন তিনিই ছিলেন সবকিছুর মালিক মোখতার। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর বড় ছেলে মৌলভি সাইয়িদ খলিলুদ্দিনের ওপর অর্পিত হয় সার্বিক দায়িত্ব। শাহ জিয়াউন নবির এমনিতে টাকার কোনো দরকার ছিল না। শুধু কোনো কিতাব কেনার দরকার পড়লে কিংবা কাউকে কিছু হাদিয়া তোহফা দিতে চাইলে টাকার প্রয়োজন অনুভব করতেন। তখন তা চেয়ে নিতেন তিনি। এছাড়া বাড়তি কোনো খরচ ছিল না তাঁর। জমিদারির হাজার হাজার টাকা আয়-আমদানি সত্তে¡ও মাসোহারা হিসেবে মাত্র ১০ টাকা নিতেন তিনি।
সাধারণ পিরেরা তো মুরিদদের বাড়িতে গিয়ে দাওয়াত খায়। তাদের থেকে গ্রহণ করে বিভিন্ন নজর-নেয়াজ। কিন্তু তিনি ছিলেন এক্ষেত্রে সম্পূর্ণ উল্টো। মুরিদেরাই বরং তাঁর খেদমতে এসে অবস্থান করত তাঁর বাড়িতে। কখনো কখনো মাসাধিককাল মেহমান হিসেবে অবস্থান করত তারা। তাঁর মুরিদদের মধ্যে ধনী-গরিব, আলেম-ফাজিল, শিক্ষিত-অশিক্ষিত সব শ্রেণির লোকই ছিল।
সাইয়িদা খাইরুন্নেসার মা ছিলেন অত্যন্ত দৃঢ় আকিদার অধিকারী, নেককার, সময়নিষ্ঠ, ধার্মিকা, বুদ্ধিমতী ও সমঝদার একজন মহিলা। অল্প বয়সেই বিয়ে হয়ে গিয়েছিল তাঁর। বিয়ের পর স্বামী আরও লেখাপড়া শেখান তাঁকে। সে যুগের রেওয়াজ ও মানের দিক থেকে ধর্মীয় কিতাবাদি পাঠে তিনি ছিলেন তুলনামূলক এগিয়ে। বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে লোকেরা তাঁর পরামর্শ গ্রহণ করত এবং অত্যন্ত গুরুত্ববহ ভাবা হতো তাঁর মতামতকে। খাইরুন্নেসার বংশে শিক্ষা, ধর্মীয় জ্ঞান, বুদ্ধি-বিবেচনা ও উপলব্ধির ক্ষেত্রে দুজন মহিলাকে বিশিষ্ট বলে মনে করা হতো। তাদের একজন ছিলেন সাইয়িদা খাইরুন নেসার মা।
সাইয়িদা খাইরুন্নেসারা ছিলেন সাত ভাইবোন। দুই ছেলে ও পাঁচ মেয়ে। বড় ভাইয়ের নাম ছিল সাইয়েদ আহমদ সাঈদ। ছোট ভাইয়ের নাম ছিল মৌলভি হাফেজ সাইয়িদ ওবায়দুল্লাহ। আর তিনি নিজে ছিলেন বোনদের মধ্যে চতুর্থ। একেবারে ছোটবোন মারা যান পিতার জীবদ্দশাতেই।
খাইরুন্নেসা বলেন, আমার বাবা সন্তানদের মধ্যে আমাকেই অধিক স্নেহ করতেন, ভালোবাসতেন এবং আমার সঙ্গেই বেশি ঘনিষ্ঠ ছিলেন তিনি। বাইরে থেকে যখনই কোনো ভালো কিতাব আসত বাবার হাতে, আমাকে তা দেখতে দিতেন এবং বই নিয়ে বিভিন্ন আলাপ-আলোচনা করতেন আমার সঙ্গে। আর এটাই ছিল তাঁর স্নেহ-ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ। আব্বা যখন রাত্রে তাহাজ্জুদের সময় কোঠার ওপর তলা থেকে নেমে মসজিদের উদ্দেশ্যে গমন করতেন তখনই ঘুম ভেঙে যেত আমার। আমি ও আমার মেজো বোন সালেহা সে সময় আম্মার কাছে ওপর তলায় চলে যেতাম। সেখানে গিয়ে মা’র সঙ্গে নফল নামাজে দাঁড়িয়ে যেতাম আমরা। আমাদের অন্যান্য বোন ও সঙ্গী-সাথিরা এ ব্যাপারে আমাদের দুজনকে ঈর্ষা করত খুবই। এবং তারাও চেষ্টা করত আমাদের সঙ্গী হবার। কিন্তু অধিকাংশ সময়ই ঘুম না ভাঙায় তাদের সেই চেষ্টা ফলবতী হতো না।
স্বভাবগতভাবেই রুটি বানানো, তরকারি পাকানো এবং সেলাই কাজের প্রতি বিশেষ আকর্ষণ ছিল তাঁর। এ ব্যাপারে তাঁর দক্ষতা ছিল অতুলনীয়। শুরু থেকেই তাঁর মস্তিষ্ক নতুন সৃষ্টির চিন্তায় বিভোর থাকত। এবং নতুনতর উদ্ভাবন ও আবিষ্কারের মাঝে আনন্দ খুঁজে পেতেন তিনি। এসব কারণে খানদানের ভেতর তাঁকে আবিষ্কারক-উদ্ভাবক মনে করা হতো। তাঁর পিতার মেজাজের মধ্যেও সূ² রুচিবোধ ছিল। সুন্দর, মানানসই ও উপযোগী জিনিস তাঁকে আকৃষ্ট করত অনেক। এজন্য তিনি অধিকাংশ সময়ে এজাতীয় কাজের ভার নিজের হাতেই তুলে নিতেন। তাঁর বাবার একটি আবাÑযা তিনি ঈদের দিন পরিধান করতেনÑ সেটাতে করা মেয়ের হাতের রেশমি কারুকাজ দেখলে মনে হবে বড় মাপের কোনো সুনিপুণ কারিগর করেছে কাজটি।
তৎকালীন সময়ে আলী মিয়া নদবির খান্দানে মেয়েদের লেখাপড়ার রীতি ছিল খুবই নির্দিষ্ট ও সীমিত পর্যায়ের। মেয়েদের বেশি লেখাপড়া পছন্দ করা হতো না তখন। ধর্মীয় বই-পুস্তক পাঠ, মাসয়ালা-মাসায়েল সম্পর্কে অল্প বিস্তার জানাশোনা এবং ঘর-গৃহস্থালির ব্যবস্থাপনা পর্যন্তই সীমাবদ্ধ ছিল তখনকার লেখাপড়া। সত্যপন্থি আলেমদের রচিত কিতাবাদিÑযা এই খানদানের আকিদা-বিশ্বাস ও ধ্যান-ধারণার সঙ্গে সামঞ্জস্যশীলÑসেগুলোই ছিল মেয়েদের পাঠ্য তালিকাভুক্ত।
কাজি সানাউল্লাহ পানিপথি রচিত (ফিকহের কিতাব) ‘মা লা বুদ্দা মিনহু’, রাহে নাজাত, কেয়ামতের আলামত সম্পর্কে হজরত শাহ রফিউদ্দিন দেহলভি প্রণীত ‘চেহেল হাদিস’ এবং শাহ আব্দুল কাদের ও শাহ রফিউদ্দিনকৃত কুরআন পাকের তরজমা পড়া হয়েছিল সাইয়িদা খাইরুন্নেসা রহ.-এর।
ফারসির প্রাথমিক বই-পুস্তকও পড়ানো হতো মেয়েদেরকে। তবে হাতের লেখা শিখতে দেওয়া হতো না মহিলাদেরকে। এর অনুশীলনও করানো হতো না তাঁদেরকে। এ ব্যাপারে খান্দানের কোনো কোনো মুরুব্বির দৃষ্টিভঙ্গি ছিল খুবই কঠোর। তাঁরা বলতেন, মেয়েরা লিখতে শিখলে অন্যদেরকে চিঠি লিখবে। কিন্তু সাইয়িদা খাইরুন্নেসার লিখবার ও সুন্দর হস্তাক্ষর অনুশীলনের আগ্রহ ছিল অত্যধিক। তিনি নিজের জ্যেষ্ঠ চাচাতো ভাই মৌলভি সাইয়িদ খলিলুদ্দিনÑযিনি সেই সময়ে খান্দানের অভিভাবক হিসেবে বিবেচিত ছিলেন- তাঁর কাছে এ বিষয়ে অনুমতি প্রার্থনা করলে তিনি তাঁর আগ্রহ ও ধর্মীয় আস্থাদৃষ্টে প্রয়োজনমাফিক অনুমতি দেন। ফলে খাইরুন্নেসা তাঁর প্রচলিত প্রথার বিপরীতে গিয়ে বেশ ভালো রকম লিখা শিখে ফেলেন। আর এটাই পরবর্তীতে বই-পুস্তক লিখতে বেশ সহায়তা করেছিল তাঁকে।
এ সময়ে আরও কিছু কিতাব তিনি অধ্যয়ন করেছিলেন। সেসব গ্রন্থ গভীর প্রভাব ফেলেছিল তাঁর জীবন ও মস্তিষ্কের ওপর। সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, কাসাসুল আম্বিয়া, মাকাসিদুস সালেহিন, মাআসিরুস সালিহিন, তিব্বি আল ফারাসিখ ইলা মানাযিলিল বারাযিখ এবং তারিকুন নাজাত।
কিছুদিন পর আরও তিনটি বই পড়ার সৌভাগ্য হয়েছিল তাঁর। সেগুলো হচ্ছেÑ
১. নবাব সাইয়িদ সিদ্দিক হাসান খান লিখিত ‘কিতাবুদ দা’ওয়াদ দাওয়া’। এটি পাঠ করার ফলে জানা যায় কুরআনি অনেক আমল। যার অনেকগুলোই নিজের নিয়মিত আমলে পরিণত করেছিলেন সাইয়িদা খাইরুন্নেসা।
২. মুজাররাবাতে দায়রাবি। এটিও খুবই উপকারী একটি কিতাব।
৩. তা’বিরুর রু’য়া। এই গ্রন্থে বিবৃত হয়েছে সেইসব ব্যাখ্যা যা মুহাম্মদ ইবনে সিরিন বলেছিলেন বিভিন্ন মানুষের স্বপ্নের ব্যাখ্যায়। ব্যাখ্যার পাশাপাশি ইবনে শিরিন সেগুলোর মূলনীতিও বলে দিয়েছিলেন। সেই বইটি পড়ে এবং নিজস্ব অভিজ্ঞতা ও আল্লাহ প্রদত্ত দূরদর্শিতার বলে স্বপ্নের ব্যাখ্যা প্রদানে খাইরুন্নেসার বিশেষ যোগ্যতার সৃষ্টি হয়ে গিয়েছিল। খান্দানের অধিকাংশ মানুষ তাঁর থেকেই জেনে নিত স্বপ্নের ব্যাখ্যা। পরবর্তীতে তাঁর বলা ব্যাখ্যাই ফলে যেতে বেশিরভাগ।
সাইয়িদা খাইরুন্নেসার বংশে পুরুষদের কুরআন হেফজ করার প্রথা থাকলেও নারীদের ছিল না। সর্বপ্রথম তিনি এবং তাঁর মেজ বোন সালেহা, ভাগ্নি এবং আরও দুই বোন শুরু করেন কুরআন মাজিদের হেফজ। প্রত্যেকেই নিজ নিজ মাহরাম কোনো আত্মীয়ের নিকট শুরু করেন এই বিরাট কর্ম। সেই অনুযায়ী সাইয়িদা খাইরুন্নেসা হেফজ শুরু করেন আপন ছোট ভাই ওবায়দুল্লাহর কাছে। ওবায়দুল্লাহ ছিলেন উঁচুমানের একজন হাফেজ। তাঁর কুরআন তেলাওয়াত ছিল খুবই সুন্দর ও বিশুদ্ধ। এই দুই ভাইবোনের মধ্যে সম্পর্কটা ছিল নিবিড় প্রীতির ও মধুর। যা খুব কম ভাইবোনের মধ্যেই দেখা যায়। পরস্পরের প্রতি তাঁরা ছিলেন উৎসর্গিতপ্রাণ। উভয়ের মধ্যে বয়সের ব্যবধান ছিল চার থেকে পাঁচ বছরের। তো তিন বছরের মধ্যেই সম্পন্ন করে ফেলেন কুরআনের হেফজ। এই সময়টাতে তাঁর আপন বড় চাচাতো ভাই মৌলবি খলিলুদ্দিন অত্যন্ত উৎসাহিত ও অনুপ্রাণিত করতেন তাঁকে। হেফজ শেষ হলে বিশাল অনুষ্ঠান আয়োজন করেন তিনি।
রমজান মাসে প্রতিদিন এক পারা করে কুরআন পড়তেন তিনি। তাঁর ছেলে আলী হাসান আলী নদবি বলেন, আমার মনে আছে, একবার আমি লুকিয়ে অনেকক্ষণ যাবৎ আমার মায়ের কুরআন তেলাওয়াত শুনছিলাম। তিনি তখন তারাবি পড়ছিলেন। আমার মনে হচ্ছিল যেন আসমান থেকে রহমের বারিধারা বর্ষিত হচ্ছে। সেদিনকার সেই আনন্দ ও স্বাদ আজ পর্যন্ত ভুলিনি আমি। বিয়ের পর তিনি আমার আব্বাজানকে কুরআন মাজিদ তেলাওয়াত করে শোনাতেন। যতদিন তাঁর স্মরণশক্তি অটুট ছিল ততদিন তিনি আপন ভাতিজা হাফেজ সাইয়েদ হাবিবুর রহমানের কাছে নিয়মিত কুরআন মাজিদের দাওর (পুনঃপাঠ) করতেন। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি নিয়মিত যে ওজিফাসমূহ আদায় করেছেন সেগুলোর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত ছিল কুরআনুল কারিমের বিভিন্ন সুরা, রুকু এবং আয়াতের সহিহশুদ্ধ তেলাওয়াত।
দোয়া ও মোনাজাতের খুব ইহতিমাম করতেন সাইয়িদা খাইরুন্নেসা। দোয়াতে প্রশান্তি খুঁজে পেতেন তিনি। তাঁর সমস্ত দোয়া হতো আস্থায় ভরপুর। আল্লাহর রহমতের ওপর তাঁর গর্বও ছিল অনেক। তাঁর মধ্যে যে ইয়াকিন ও দৃঢ় প্রত্যয় ছিল তা অনেক ভালো ভালো লোকের মধ্যেও তেমন একটা দেখা যায় না।
তিনি বলেন, একবার তেলাওয়াতকালে এই আয়াতটি চোখে পড়ে আমারÑ
(অর্থ), (হে নবি!) আমার বান্দাগণ যখন আপনার কাছে আমার সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে, তখন (আপনি তাদেরকে বলুন যে,) আমি কাছেই আছি। প্রার্থনাকারী যখন আমার নিকট প্রার্থনা করে আমি তার প্রার্থনায় সাড়া দেই। সুতরাং তারাও আমার ডাকে সাড়া দিক আর আমার প্রতি ইমান আনুক, যাতে তারা ঠিক পথে চলতে পারে।
তখন বহুবার পড়েছি আমি এই আয়াত। যথাসম্ভব সেই সময় এই আয়াতটি মুখস্থ করছিলাম আমি। হঠাৎ আমার যেন চোখ খুলে গেল এবং আমার মনে হলো যেন হারিয়ে যাওয়া কোনো জিনিস আমি খুঁজে পেয়েছি। নতুন কোনো সত্য ধরা পড়েছে আমার কাছে। মনে হচ্ছিল যেন আমার মনের পর্দায় উপরিউক্ত বক্তব্যটি খোদাই করে দিয়েছে কেউ। ফলে তা বসে গিয়েছে হৃদয়ের গভীরে। ব্যাস, আর কি! আমি যেন কোনো রাজভান্ডারের সন্ধান পেয়ে গেছি। যার চাবিও রয়েছে আমার হাতের নাগালে। আমি শক্তভাবে তা আঁকড়ে ধরলাম এবং মজবুতভাবে ধারণ করলাম। দোয়ার এমন এক অনির্বচনীয় স্বাদ ও তৃপ্তি অনুভব করলাম যে আমার সমগ্র সত্তায় আপ্লুত হয়ে গেল। অপরদিকে শুরু হলো আজব এক ব্যাকুলতা, যা সর্বদাই ঘিরে রাখত আমাকে। জীবনের পরিণতি, ভবিষ্যতের চিন্তা, সৌভাগ্য ও সফলতা লাভের আগ্রহ ও বাসনা সবসময় আমার মন-মস্তিষ্ককে আচ্ছন্ন করে রাখত। এই সার্বক্ষণিক ব্যাকুলতা থেকে কোনো কিছুর মাধ্যমে একটু শান্তি পাওয়ার হলে তা ছিল দোয়া ও মুনাজাত। এটাই ছিল আমার ব্যথার মলম, আত্মার খোরাক এবং আমার আহত অন্তরের প্রলেপ।
তাঁর গোটা জীবনই কেটেছে দোয়ার মধ্য দিয়ে। কুরআন ও হাদিসের উল্লিখিত দোয়া এবং মুনাজাত ছিল তাঁর আহার-বিহার, শয়ন-স্বপন ও নিদ্রা-জাগরণ এমনকি সকল সমস্যা-সংকট ও দ্বিধা দোদুল্যমানতায় নিত্যসঙ্গী।
তিনি আরও বলেন, দোয়া ছিল আমার খোরাক। দোয়া ছাড়া অন্য কিছুতে তৃপ্তি আসত না আমার। দোয়ার মধ্যে এতটাই মগ্ন হয়ে পড়েছিলাম আমি যে, স্বাভাবিক কাজকর্মেও ব্যাঘাত ঘটতে থাকে প্রচুর। সাধারণ কোনো কথা বলতে গেলেও সঙ্গে কোনো দোয়া জুড়ে দিতাম আমি। একটি মুহূর্তও আমার দোয়া ছাড়া অতিবাহিত হতো না। জুম্মার দিন ছিল আমার জন্য ঈদের ন্যায় আনন্দময় দিন। আসলেও তো এটি ঈদের দিনই বটে। দিনভর শুধু দোয়া করতাম। বিশেষ করে আসর থেকে সূর্য ডোবা পর্যন্ত একাকী বসে এমনভাবে ডুবে যেতাম দোয়ার মধ্যে, কোনো দিকে চোখ তুলেও তাকাতাম না। মোরগের প্রতিটি ডাকে এবং প্রত্যেক আজানের মুহূর্তে দোয়া করতাম আমি। দোয়া কবুলের সম্ভাব্য কোনো একটি মুহূর্তই নষ্ট করিনি যথাসম্ভব। আর কোনো কথা বলতেও বাদ দিতাম না দোয়াতে। সব বলতাম। সব ধরনের ভয়ভীতি থেকে নিরাপত্তা চাইতাম আল্লাহর দরবারে। আরও চাইতাম সকল প্রকার কল্যাণরাজি। দোয়া করতে করতে এতটাই জোশ এসে যেত আমার মধ্যে, নিজেকে হারিয়ে ফেলতাম একেবারে। চোখের পানিতে ভিজে যেত আমার সবকিছু। আল্লাহর অপার কুদরতের শান দর্শনে ছটফট করতাম ঠিক যেমন ডানা ঝাপটায় জবাইকৃত মোরগ। কিন্তু এই আত্মহারা ও অস্থির অবস্থায়ও দোয়া অব্যাহত থাকত আমার। সিজদা থেকে ততক্ষণ কিছুতেই মাথা উঠাতাম না যতক্ষণ না অন্তরে প্রশান্তি অনুভব করতাম। দোয়া শেষে ভিতরে এতটাই হালকা অনুভব হতো যেন রহমতের দরজাগুলো খুলে গেছে আমার জন্য। আর আমি সেই রহমতের ভান্ডার লুটছি দু হাতে।
সন্তানাদিকেও তিনি শিখিয়েছিলেন আল্লাহর কাছে চেয়ে নিতে। তাঁর ছেলে আলী নদবি বলেন, শৈশব থেকেই আমাদের মা আমাদের ভাই-বোনদেরকে অভ্যস্ত করিয়েছিলেন দোয়া-মোনাজাতে। আমার মনে আছে, আমি যখন কিছুটা লেখাপড়া করার বয়সে উপনীত হলাম তখন তিনি আমাকে বলেছিলেন, তুমি যখন কিছু লিখতে যাবে তখন শুরুতে বিসমিল্লাহ লেখার পর এই কথাটা লিখবে,
اللهم آتني بفضلك أفضل ما تؤتي عبادك الصالحين
অর্থ, হে আল্লাহ! আপনি নিজ অনুগ্রহে আমাকে সেই সর্বোত্তম জিনিস দান করুন যা আপনি আপনার নেক বান্দাদের দিয়ে থাকেন।
প্রতিটি মুহূর্তের এতসব দোয়া ও মাসনুন অজিফা তাঁর মুখস্থ ছিল যা এ যুগের মাদরাসা-মক্তবের অনেক ভালো ভালো ওস্তাদদেরও মুখস্থ নেই।
খাইরুন্নেসার বিয়ের বয়স হওয়ার পর তাঁর সমবয়সী কয়েকজন বোন ও আত্মীয়েরও বিয়ে হয়ে যায়। কিন্তু তাঁর বিয়ে নিয়ে মা-বাবা কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারছিলেন না তখন পর্যন্ত। তাঁর জন্য বিয়ের প্রস্তাব ছিল আপন চাচাতো ভাইয়ের পক্ষ থেকে। যার সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল তার বড় বোনের। এক ছেলে ও এক মেয়ে রেখে ইন্তেকাল হয়ে যায় সেই বড়বোনের। অতঃপর ছোট জনকে প্রস্তাব দেন সেই চাচাতো ভাই। চাচাদের ঘরে পার্থিব সর্বপ্রকার সুখ-সমৃদ্ধি ও প্রাচুর্য ছিল। কিন্তু ধর্মীয় রুচিবোধ ও শিক্ষাদীক্ষা ছিল না খুব একটা। স্বাভাবিকভাবে বিয়ে হবার মতো সংগত সকল প্রকার কার্যকারণ ও উপকরণ বিদ্যমান ছিল সেই বাড়িতে। তাছাড়া দূরে কোথাও নয়; বরং সম্পর্কটা ছিল নিজের বাড়িতে। এই সম্বন্ধের বেলায় তার মা ছিলেন খুবই উৎসাহী। তবে তাঁর বাবার মত ছিল না তেমন একটা।
ওদিকে মাওলানা হাকিম সাইয়িদ আব্দুল হাই রহ.-এর প্রথম বিয়ে হয়েছিল ১৩০৯ হিজরিতে তারই আপন মামাতো বোনের সঙ্গে। কিন্তু ১৩১৯ হিজরিতে ইন্তেকাল হয়ে যায় সেই নারীর। তাঁর গর্ভে জন্ম নিয়েছিল এক সন্তান। এই আকস্মিক দুর্ঘটনা হাকিম সাহেবের ওপর এতটাই প্রভাব ফেলে, তিনি সেসময় ৩৩ বছরের তাগড়া যুবক হয়েও আর বিয়ে করবেন না বলে সিদ্ধান্ত নেন।
হাকিম আব্দুল হাইয়ের বাবা সাইয়িদ ফখরুদ্দিনের সঙ্গে বিশেষ সম্পর্ক ছিল শাহ জিয়াউন নবির সঙ্গে। তাঁরা উভয়েই ছিলেন মাওলানা খাজা আহমদ নাছিরাবাদির খলিফা। এছাড়া আত্মীয়তা ও পারিবারিক সম্পর্ক ছিল তাঁদের মধ্যে। ফলে পরস্পরের মধ্যে ঐক্য ও সম্প্রীতি বজায় ছিল। তো ছেলের জীবনে অনাকাক্সিক্ষত দুর্ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর সাইয়িদ ফখরুদ্দিনের মনে আকাক্সক্ষা জাগে, ছেলের দ্বিতীয় বিয়েটা শাহ জিয়াউন নবির মেয়ে খাইরুন্নেসার সঙ্গে দিবেন। সে সময়ে তিনি ছিলেন বিয়ের জন্য সর্বাংশে উপযুক্ত। তাছাড়া দ্বীনদারিতা, আচার-আচরণ, ব্যবহারিক রীতিনীতি ও লেখাপড়ার প্রতি বাড়তি আগ্রহের জন্য তিনি অত্যন্ত আদরণীয় ছিলেন হাকিম মৌলভি ফখরুদ্দিনের কাছে। বাবার খুব আগ্রহ থাকলেও ছেলে হাকিম সাইয়িদ আব্দুল হাইয়ের তেমন কোনো উৎসাহ ছিল না। সৌভাগ্যের হাতছানি সত্তে¡ও তিনি ছিলেন এ ব্যাপারে নির্লিপ্ত ও নিশ্চুপ। পরবর্তীতে হাকিম সাইয়িদ ফখরুদ্দিন ছেলে আব্দুল হাইয়ের বন্ধু মুন্সি আব্দুল গনির মাধ্যমে রাজি করান ছেলেকে। অতঃপর বিয়ের প্রস্তাব পাঠান শাহ জিয়াউন নবির পরিবারে।
উল্লেখ্য যে, শাহ জিয়াউন নবির বাড়ি ছিল খানাপিনা, প্রাচুর্য ও জাঁকজমকে পরিপূর্ণ। কিন্তু সাইয়িদ হাকিম ফখরুদ্দিনের বাড়ি ছিল ঠিক তার উল্টো। দীর্ঘকাল থেকে এখানে না ছিল কোনো জমিদারি আর না কোনো সহায় সম্পত্তি। খান্দানের এই শাখায় বহু আগে থেকেই চলে আসছিল ইলমে দ্বীনের ধারাবাহিকতা। এবং এটি প্রসিদ্ধ ছিল মৌলভি পরিবার নামে। এই পরিবারের সহায়-সম্পদ বলতে ছিল স্তূপীকৃত কিতাব এবং দ্বীনি ইলম। ফলে সেই বাড়িতে সব সময় জাগতিক অভাব-অনটন ও অসচ্ছল অবস্থাই বিরাজ করত। হাকিম ফখরুদ্দিন ছিলেন একজন অভিজ্ঞ চিকিৎসক, বিদগ্ধ মনীষী ও লেখক। কিন্তু প্রকৃতিগতভাবে তিনি ছিলেন নিষ্পৃহ, উদাসীন ও অত্যন্ত আত্মমর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তিত্ব। জীবন-জীবিকার প্রতি কখনোই তেমন মনোযোগ দেননি তিনি। ফলে কোনো কোনো সময় বাড়ির লোকজন অনাহারে থাকাটা ছিল একদমই স্বাভাবিক।
আবার ছেলে আব্দুল হাই নাজেম হিসেবে দায়িত্ব পালন করতেন ভারতের দারুল উলুম নদওয়াতুল উলামায়। সেই সূত্রে ৩০-৪০ টাকার মতো বেতন পেতেন তিনি। কিন্তু পরে এ টাকা গ্রহণ করাও তিনি ছেড়ে দেন। এমতাবস্থায় যখন বিয়ের পয়গাম পৌঁছুল শাহ জিয়াউর নবির বাড়িতে তখন এই পয়গাম কবুল করা সাইয়িদা খাইরুন্নেসার মায়ের পক্ষে বেশ দুষ্কর হয়েই দেখা দিল। বেশ দ্বিধায় পড়ে গেলেন তিনি। কেননা মহিলারা সাধারণত এসব ব্যাপারে অত্যন্ত দূরদর্শী ও অনুভ‚তিপ্রবণ হয়ে থাকেন। উভয় পরিবারের বাড়ি ছিল পরস্পর সংলগ্ন। ও বাড়ির অবস্থা সম্পর্কে ভালো রকম জানা ছিল তাঁর। প্রথম সম্বন্ধের তুলনায় এটাকে প্রাধান্য দেওয়ার কোনো কারণ খুঁজে পাচ্ছিলেন না তিনি। জেনেশুনে নিজের মেয়েকে কষ্টে নিপতিত করা বুদ্ধিমত্তার পরিচয় ছিল না তাঁর মতে। কিন্তু জিয়াউন নবি রহ. ঠিকই অবগত ছিলেন হাকিম সাইয়িদ আব্দুল হাইয়ের যোগ্যতা ও জ্ঞান-গরিমা সম্পর্কে। প্রস্তাব পেয়ে আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে ওঠেন তিনি। যেন এতদিন এরই অপেক্ষায় ছিলেন। স্ত্রীকে পরিষ্কার জানিয়ে দিলেন, সাইয়িদ আব্দুল হাই বয়সে যুবক, নেককার আলেম এবং তাঁর ভবিষ্যৎ অত্যন্ত সম্ভাবনাময়। তাঁর মোকাবেলায় আমি আর কাউকে প্রাধান্য দিতে পারি না। আমার কাছে দারিদ্র্য ও ধনাঢ্যতা কোনো বিষয় না। মূল হচ্ছে, যোগ্যতা ও জ্ঞান-বুদ্ধি। সেটা সাইয়িদ আব্দুল হাইয়ের মধ্যে পূর্ণমাত্রায় বিদ্যমান।
এই বিয়ে সম্পর্কে সাইয়িদা খাইরুন্নেসা নিজ রচিত ‘আদ দু’আ ওয়ার কদর’ নামক গ্রন্থে লিখেন,
“আমার বিয়ের ক্ষেত্রে সবার বেশি আগ্রহ ছিল আমার চাচার ঘরের প্রতি। বড় দুই বোনের বিয়ে হয়েছিল সেই বাড়িতেই। বহুকাল থেকেই সেই বাড়ি ছিল সচ্ছলতা ও প্রাচুর্যে ভরপুর। পার্থিব দিক দিয়ে বলা যায় তুলনাহীন। ধন-সম্পদ, ইজ্জত-সম্মান, লজ্জা-শালীনতা এবং আচার-ব্যবহার সব দিক দিয়ে এর চেয়ে ভালো ঘর ও উত্তম সম্বন্ধ আর ছিল না তখন। আমার মরহুমা আম্মার আন্তরিক আকাক্সক্ষা ও আগ্রহ ছিল সেদিকেই। আপন ভাইয়ের ঘরের চাইতেও এই ঘরকে তিনি প্রাধান্য দিতেন বেশি। আমারও প্রিয় ছিল সেই ঘর। সবকিছুই আমার অনুক‚লে ছিল। কিন্তু মরহুম আব্বার খেয়াল ছিল, দরিদ্র হোক ক্ষতি নেই। কিন্তু মুত্তাকি ও পরহেজগার হতে হবে অবশ্যই। এই গুণটিরই কমতি ছিল আমার চাচার ঘরে।”
সাইয়েদা খাইরুন্নেসার ছেলে আবুল হাসান আলী নদবি বলেন, এরকম দ্বিধাদ্ব›দ্ব ও টানাপোড়নের ভেতর দিয়ে অপেক্ষাকালে আমার আম্মা এমন কিছু স্বপ্ন দেখেন যেগুলো ইঙ্গিত ছিল আব্বার বাড়ির দিকে। বলা হচ্ছিল, এই দুই বাড়ির মধ্যে সম্বন্ধ স্থাপিত হলে আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে বিশেষ অনুগ্রহ বর্ষিত হবে।
একবার খাইরুন্নেসা স্বপ্নে দেখেন, আল্লাহর পক্ষ থেকে একটি আয়াতে কারিমা লাভ করেছেন তিনি। যেটা সকাল অবধি মুখে ছিল তাঁর। আয়াতটি হচ্ছেÑ
কেউ জানে না তাদের জন্য নয়ন প্রীতিকর কী লুকায়িত রাখা হয়েছে তাদের কৃতকর্মের পুরস্কারস্বরূপ।
এই স্বপ্ন দেখার পর থেকে আনন্দিত হয়ে ওঠেন তিনি। সব ধরনের দুশ্চিন্তা দূর হয়ে যায় তাঁর। পরে স্বপ্ন শুনে তাঁর বাবা জিয়াউন নবিও আনন্দে কাঁদা শুরু করে দেন।
একপর্যায়ে সব দ্বিধাদ্ব›দ্ব কাটিয়ে সাইয়িদা খাইরুন্নেসার বিয়ে হয় হাকিম সাইয়িদ আব্দুল হাইয়ের সঙ্গে। ১৩২২ হিজরিতে অত্যন্ত সুন্দর ও সুচারুরূপে সম্পন্ন হয় এই বিয়ে। বিয়ের পর শ্বশুরবাড়িতে আসার পর তাঁর শাশুড়ি বাড়িঘরের যাবতীয় দায়িত্ব বুঝিয়ে দেন পুত্রবধূর কাছে। অতঃপর নিজেরা সবকিছু থেকে মুক্ত হয়ে যান একদম।
শ্বশুরবাড়ি এসে আগে থেকেই শোনা সেই টানাপোড়েনের চিত্রই দেখতে পেলেন তিনি। কখনো সচ্ছলতা তো কখনো অর্ধাহার কিংবা অনাহার।
মেয়ে বিয়ে দেওয়ার পর থেকেই মা সব সময় চিন্তা করতেন, না জানি মেয়েটা আমার কী কষ্টে আছে! তাই প্রায়ই ছেলেকে পাঠাতেন, মেয়ের বাড়িতে রান্নাবান্না হচ্ছে কিনা তা দেখে আসতে। রান্নাবান্না না হলে খাবার পাঠিয়ে দিতেন তাদের জন্য। সাইয়িদা খাইরুন্নেসা অনেক সময় বাপের বাড়ির কাউকে আসতে দেখলে চুলায় হাঁড়ি বসিয়ে দিতেন এবং জাল দিতে থাকতেন। আগন্তুক যেন দেখে বুঝতে পারে, রান্না চলছে বাড়িতে। অথচ হাঁড়িতে তখন পানি ছাড়া আর কিছু থাকত না। অনেক সময় এ বিষয়টাও ঠিকই ধরে ফেলতেন মা।
এভাবে কিছুদিন চলার পর তাঁর স্বামী সাইয়িদ আব্দুল হাই হেকিমি শুরু করার নিয়ত করেন। এ ব্যাপারে স্ত্রীর পরামর্শ চাইলে তিনি জোর সমর্থন করেন। অতঃপর স্বামী এই পেশায় যোগ দিতেই দূর হয়ে যায় সকল পেরেশানি। আসতে থাকে প্রচুর অর্থকড়ি। খুব দ্রæতই বরকত ও উন্নতির মুখ দেখা যায়। পাল্টে যায় ঘরের আকৃতি। শুরু হয় ঘরবাড়ির সংস্কার ও নির্মাণ কাজ। একসময় কুঁড়েঘর রূপান্তরিত হয় বিশাল দালান বাড়িতে।
শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে সাইয়েদা খাইরুন্নেসা স্বামীর আগের ঘরের সন্তানকে এমনভাবে আপন করে নেন যে, তারা নিজেদের মরহুম মায়ের কথা ভুলেই যায় একেবারে। তাঁর বুদ্ধি পরামর্শেই বাড়ির অবস্থার ভালো উন্নতি হয়। যে বাড়ির লোকেরা একসময় নিজেরাই অনাহারে কাটাত এখন সেখানে অন্যান্য বাড়ির তুলনায় বেশি মেহমানের আগমন শুরু হয়। রায়বেরেলি ও লখনৌর পার্শ্ববর্তী এলাকার আপন-পর সবরকম লোকের নিরাপদ আশ্রয় কেন্দ্রে পরিণত হয় তাঁদেরই বাড়ি।
সাইয়িদ আব্দুল হাইয়ের আগের ঘরের সন্তানকে সাইয়িদা খাইরুন্নেসা যেমন আপন করে নিয়েছিলেন তেমনি সেই সন্তান নিজের মায়ের মতোই শ্রদ্ধা করতেন খাইরুন্নেসাকে। নিজের মা এবং সৎমার মাঝে কোনো পার্থক্য করতেন না তিনি। খাইরুন্নেসা সবসময় নিজের গর্ভের সন্তানের চেয়ে তাঁকে বেশি অগ্রাধিকার দিতেন সবসময়। তাঁর বিয়ের ব্যবস্থাপনাও তিনি খুব সুন্দর ও সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করেছিলেন।
এভাবে হাসিখুশি আর আনন্দেই দিন যাচ্ছিল তাঁদের। এর মধ্যে হঠাৎ ১৩৪১ হিজরির জুমাদাল উখরা মাসের ১৫ তারিখে মারা যান তাঁর স্বামী সাইয়িদ আব্দুল হাই। তাঁর মৃত্যু হয়েছিল একদমই আকস্মিক। সারাদিন নিয়মিত সব কাজ সম্পন্ন করেছিলেন তিনি। মাত্র দুই ঘণ্টার ব্যবধানে তিনি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন।
স্বামীর মৃত্যুতে শোকাভিভ‚ত হয়ে পড়েন সাইয়িদা খাইরুন্নেসা। কিন্তু আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্ধারিত তাকদির হিসেবে অবনত মস্তকে মেনে নেন সবকিছু। ধৈর্য ধরেন এই মসিবতে।
স্বামীর মৃত্যুর পর তাঁর দিন কাটত ইবাদত-বন্দেগি করে। সেই সঙ্গে কাউকে দিয়ে ধর্মীয় বইপুস্তক পড়িয়ে শুনতেন তিনি। এই বই পড়ে শোনানোর কাজটা অধিকাংশ সময় করতেন তাঁর ছেলে আবুল হাসান আলী নদবি রহ.।
এছাড়াও তিনি মুনাজাত ও বিভিন্ন কবিতা লিখে নিজের শোক-দুঃখ ভুলতে চেষ্টা করতেন। খান্দানের বাচ্চাদেরকে নিজের কাছে রেখে লেখাপড়া শেখাতেন। আদব-কায়দা শিখিয়ে ভদ্র ও সুশীল করে গড়ে তুলতেন তাদেরকে। নিজের মনকে সান্ত¡না দিতে এসবের মধ্যে ব্যস্ত থাকতেন তিনি।
তাঁর মুনাজাত ও কাব্যের প্রথম সংকলন ‘বাবে রহমত’ নামে বের হয় ১৯২৫ খ্রিষ্টাব্দে। অল্পদিনেই গ্রন্থটি বেশ জনপ্রিয়তা পায়Ñ ঘরে ঘরে পৌঁছে যায় সেই গ্রন্থের একেকটি কপি।
দাম্পত্য সম্পর্কের আদব-কায়দা, নীতিমালা, পরস্পরের অধিকার ও দায়িত্ব-কর্তব্য এবং ঘর-গৃহস্থালি সম্পর্কে একটি বই লিখেন তিনি। ‘হুসনে মুআশারাত’ নামে সেটি মুদ্রিত ও প্রকাশিত হয়।
এছাড়া রান্নাবান্না বিষয়ে একটি বই লিখেন তিনি। সেটি ‘যায়িকা’ নামে ১৯৩০ সালে লখনৌর নামী প্রেস থেকে প্রকাশিত হয়ে বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করে।
সন্তানদেরকে দ্বীনি শিক্ষায় শিক্ষিত করতে খুবই তৎপর ছিলেন তিনি। তাঁর ছেলে আবুল হাসানকে ইংরেজি শিক্ষায় তিনি শিক্ষিত হতে দেননি। যদিও তৎকালীন সময়ে ধর্মীয় শিক্ষার তুলনায় ইংরেজি শিক্ষার মান ছিল অনেক বেশি।
১৩৬৬ হিজরির শাবান মাসের ৭ তারিখ বৃহস্পতিবার সাইয়িদা খাইরুন্নেসা বের হন হজব্রত পালনে। সঙ্গে ছিল নিজের ছেলে আবুল হাসান আলী নদবি, পুত্রবধূ এবং মেয়ে। সেই সফরে অনেক অদৃশ্য সাহায্য পাওয়া গিয়েছিল আল্লাহর পক্ষ থেকে। তা মূলত আল্লাহর দরবারে সাইয়িদা খাইরুন্নেসার মাকবুলিয়্যাত তথা গ্রহণযোগ্যতারই আলামত।
মৃত্যুর আগে বার্ধক্যজনিত দুর্বলতায় পড়ে গিয়েছিলেন তিনি। ক্ষীণ হয়ে এসেছিল তাঁর দৃষ্টিশক্তি। দু’চোখেই অপারেশন করতে হয়েছিল তাঁর। এতকিছু সত্তে¡ও তাঁর নিয়মিত আমল, দোয়া-দরুদ অজিফা পাঠ এবং ইবাদত-বন্দেগিতে কমতি হয়নি একটুও। বরং বৃদ্ধি পেয়েছে উত্তরোত্তর।
বার্ধক্যজনিত দুর্বলতায় শেষ পর্যন্ত একাকী হাঁটাচলা ও নড়াচড়া করাও কষ্টকর হয়ে দাঁড়ায় তাঁর জন্যে। কিন্তু আল্লাহ তাআলার অশেষ অনুগ্রহ ছিল তাঁর প্রতি। তিনি তাঁকে অনুগত সন্তানসন্ততি এবং নাতিপুতি দান করেছিলেন। যারা অসহায়ত্ব ও অক্ষমতা অনুভব করতেও দেননি তাঁকে। বরং সর্বদাই আন্তরিকভাবে সবাই পাশে থেকেছেন তাঁর। এটাকে সকলে নিজেদের কেবল সৌভাগ্যের ব্যাপারই নয়, বরং ইবাদত মনে করত।
জীবনসায়াহ্নে পৌঁছেও তিনি ইসলামের বিজয় ও দ্বীনের বিস্তার দেখতে চাইতেন সবসময়। এ জাতীয় সংবাদে খুব আনন্দিত হতেন তিনি। উপস্থিত শোক-দুঃখ ভুলে যেতেন তখন। মাঝেমধ্যে তাঁর শায়খ মাওলানা মুহাম্মদ ইলিয়াস রহমাতুল্লাহি আলাইহির মতো দরদ দেখা যেত তাঁর মধ্যে।
তিনি চাইতেন, তাঁর ছেলে আবুল হাসান আলীর মাধ্যমে যেন দ্বীন শক্তিশালী হয়। ইসলামের প্রচার-প্রসার ঘটে। অনেক সময় তাঁকে জিজ্ঞেস করতেন, আলী! তোমার হাতে কি কেউ কখনো মুসলমান হয়েছে? উত্তরে তিনি বলতেন, হ্যাঁ দু’একজন তো কালেমা পড়েছে। এটা শুনে খাইরুন্নেসা বলতেন, আমার আশা তোমার হাতে দলে দলে মানুষ মুসলমান হোক। একদিন তিনি আফসোস করে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ছিলেন। এটা দেখে কাছে থাকা একজন বলে ওঠেন, আসলে আপনি কী চান বলুন তো? আপনি কি চান আলী নবি হয়ে যাক? তিনি বললেন, না। আরে বোকা, আমি তো জানিই নবুয়তের দরজা বন্ধ হয়ে গেছে। তাই আর কারো নবি হওয়া সুযোগ নেই। তবে আমার মন চায়, আলীর হাতে যেন অসংখ্য মানুষ ইসলাম কবুল করে। পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত পর্যন্ত যেন নিনাদিত হয় ইসলামের বিজয়ডঙ্কা।
১৩৮৮ হিজরির জুমাদাল উখরা মাসের ৬ তারিখ শনিবার জোহরের পর ইন্তেকাল করেন এই রতœগর্ভা বিদুষী নারী। পরের দিন রবিবার বিপুলসংখ্যক আলেম-ওলামা, বুজুর্গ, ছাত্র ও তাবলিগের সাথিদের উপস্থিতিতে অনুষ্ঠিত হয় তাঁর জানাজার নামাজ। অতঃপর তাঁর স্বামী হাকিম সাইয়িদ আব্দুল হাইয়ের পাশে এবং শাইখুল মাশায়েখ হজরত শাহ আলামুল্লাহর সহধর্মিনীর পায়ের দিকে দাফন করা হয় তাঁকে।